ধার নিয়ে বন্ধুর ফাঁকিবাজির পরিণতি

 
বেশ কয়েকদিন ধরে মুহিবের বাবার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না।তাই সে ডাক্তার দেখাতে চাচ্ছে কিন্তু এই মহুুর্তে তার হাতে পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় সে তার বাবাকে ডাক্তারের কাছে নিয়েও যেতে পারছে না।ফলে সে তার গ্রামের এক প্রতিবেশী বড়ো ভাই ইয়াছিনের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নেওয়ার চিন্তা করলো।ইয়াছিনের সাথে দেখা হলে সে বিনীত কন্ঠে তার বাবার অবস্থা বর্ণনা দিয়ে বলল,

ইয়াছিন ভাই,আপনার কাছে কি দুই হাজার টাকা হবে?আমার বাবার অবস্থা তেমন ভালো না তাই বাবাকে ডাক্তার দেখাতে চাচ্ছিলাম।এই মাসের শেষের দিকেই আপনার টাকা দিয়ে দেবো।আপনার কাছে টাকাগুলো পেলে আমি অনেক উপকৃত হবো,ভাই।এভাবেই অনেকটা অসহায় ভঙ্গিতে কথাগুলো অনার্স পড়ুয়া ইয়াছিনকে বলছিলো গ্রামের প্রতিবেশী এক ছোটো ভাই মুহিবুর রহমান মুহিব।

ইয়াছিন তাকে ভরসা দিয়ে হাসিমুখে বলল,আচ্ছা ঠিক আছে,তুমি কোনো চিন্তা করো না,মুহিব!তুমি চাচার ডাক্তার কবে দেখাতে চাও?

--ভাই,দুই একদিনের মধ্যে দেখালেই ভালো হতো।

--ভাই মুহিব,পরশু আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে আমার কিছু টাকা পাওয়ার কথা আছে।আমি তার কাছ থেকে পরশু টাকা পেয়েই তোমাকে দুই হাজার টাকা দিয়ে দেবো।ইন শা আল্লাহ!এ নিয়ে তুমি চিন্তা করো না।

আর শোনো,অসুস্থতা আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি পরীক্ষা।আমাদের প্রত্যেককেই জীবনের কোনো না কোনো সময় এ পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়। ধৈর্য্যের সাথে এ পরীক্ষার মোকাবেলা করতে হয়। সুতরাং চাচাকে নিয়ে তুমি একদমই চিন্তা করো না,ভাই আমার।আল্লাহর রহমতে চাচা শীঘ্রই সুস্থ হয়ে উঠবেন।তুমি সবসময় সময়মতো সালাত আদায় করে চাচার জন্য দোয়া করতে ভুলো না কিন্তু।আর হ্যাঁ,কোনো ডাক্তারের টিকেট সংগ্রহ করে দেওয়ার জন্য কিংবা ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে যাওয়ার জন্য চাচার সাথে যাওয়ার প্রয়োজন পড়লে তুমি আমাকে নির্দ্বিধায় বলো।কেমন?

--আপনাকে অনেক ধন্যবাদ,ভাই।আপনার কথাগুলো শুনে খুব ভালো লাগলো।আর পরশু আমি আপনাকে ফোন দিয়ে আসবো।

--অসুবিধে নেই!টাকাগুলো পাওয়ার পর আমিই তোমাকে ফোন দেবো।

এদিকে ইয়াছিনের কিছু টাকা তার বন্ধু জাভেদের কাছে পাওনা আছে।তাই সে তার বন্ধুকে টাকা ফেরত দেওয়ার একদিন বাকি থাকতেই মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য ফোন দিয়ে বলল,

হ্যালো,জাভেদ!কাল তো আমাকে তোর টাকা দেওয়ার কথা।একটু সকাল সকাল দিয়ে দিলে ভালো হয়,বন্ধু।

--দোস্ত,আমাকে না আরও দুদিন সময় দিতে হবে।

--কী বলছ এসব!আমি তো তোর কাছ থেকে টাকা পেয়ে আরেকজনকে দেবো বলে ইতোমধ্যে কথাও দিয়ে দিয়েছি।তার বাবা খুবই অসুস্থ। ডাক্তার দেখাবে বলে আমার কাছে ধার চেয়েছিলো।তাছাড়া,তোর যখন আরও দুদিন সময় লাগবে তবে তুই আমাকে আগে কেনো জানাস নি?এখন আমি ফোন দেওয়াতে কেনো এসব বলছিস?তুই যদি আমাকে আগে জানাতি তবে আমি ঐ লোকটিকে অন্তত কথা দিতাম না। আমি তো ভেবেছিলাম তুই টাকাটা দিয়ে দিবে তাই তাকে কথা দিয়েছিলাম।এখন কী যে করি!

--সরি,দোস্ত!কোনোরকমে এখন এটি মেনেজ করে ফেল না,দোস্ত।

--দেখিস,দুই দিন পর কিন্তু আর যেনো মিস না হয়।

--ওকে,দোস্ত!

পরদিন মুহিতের সাথে দেখা হলে ইয়াছিনের দুঃখ প্রকাশ করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকলো না। সে মুহিতের হাত ধরে বলল,ভাই!আমি খুবই দুঃখিত।আমি তোমাকে সেদিন কথা দিয়েছিলাম যে,পরশু অর্থাৎ আজ তোমাকে টাকাটা দেবো। কিন্তু আমার বন্ধুর কিছু সমস্যা থাকার কারণে সে আজ টাকা দিতে পারবে না বলে আমাকে জানিয়েছে।সে বলেছে,সে আরও দুদিন পর দিবে। তাই আমি বলছিলাম কী!তুমি যদি একটু কষ্ট করে দুই দিনের জন্য অন্য কারো কাছ থেকে ধার নিয়ে চাচার ডাক্তার দেখিয়ে নিতে তবে আমি দু'দিন পরেই তোমাকে টাকাগুলো দিয়ে দিতাম।

--ঠিক আছে,ভাই!আপনাকে আমি কষ্টের মধ্যে ফেলে দিলাম।

--না,না!আমি বরং টাকাটা দিতে না পেরে তোমাকে কষ্টের মধ্যে ফেলে দিয়েছি।

--সমস্যা নেই,ভাই।আপনার আন্তরিকতাতেই আমি খুশি।

এদিকে নতুন করে আবার জাভেদের নেওয়া দুদিনের সময় ফুরিয়ে যাওয়ার আগে ইয়াছিন তাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলো, 

--হ্যালো,জাভেদ!কাল তো তোর দুদিনের শেষ দিন।আমি কি কাল তোর বাড়িতে আসবো,বন্ধু?

--ও হ্যাঁ দোস্ত!কী করে যে তোকে বলি,দোস্ত! আমাকে আরও কটা দিন সময় দেস না রে দোস্ত!

--কী আশ্চর্য!তুই এসব কী শুরু করে দিয়েছিস? ওই তারিখটাও তুই মিস করলি।সেদিনও তুই বললি যে, দুদিন পরেই টাকাগুলো দিয়ে দিবে।আজ আবার তুই নতুন করে তালাবাহানা শুরু করে দিয়েছিস।এর আগেও একবার লম্বা সময় নিয়ে তারিখ পিছিয়েছিস।আসলে,তোদের যে কতো মুখ আমি ঠিক বুঝতে পারি না।তোর নিজের মুখ দিয়ে দেওয়া কথাটিও তুই রাখছিস না।তোর নিজের কাছেও কি এরকম বারবার কথা ভঙ্গ করার লজ্জা হয় না?

শোন,কাজটা কিন্তু তুই একদমই ঠিক করছিস না। সেদিন ওই ব্যক্তিকে কথা দিয়ে টাকাটা দিতে না পারায় আমি তার কাছে কথা ভঙ্গ করার লজ্জা পেয়েছিলাম।এরকম কোনোদিন-ই আমি কারো কাছে কথা দিয়ে কথা ভঙ্গ করি নি।আর তোর কারণেই সেদিন আমার ওয়াদা ঠিক রাখতে পারি নি।কিন্তু তারপরও তোর কথামতো আমি তাকে আরও দুদিন পরে দেবো বলে কথা দিয়েছিলাম।আজ দেখছি তুই আবারও আমাকে লজ্জায় ফেলে দিবে।এদিকে সামনের সপ্তাহে আমার টিউশন ফিও দেওয়ার কথা।এখন তুই আমাকে আজ না কাল বলে বলে কোন বিপদের দিকে যে নিয়ে যাচ্ছিস তা আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।এসব চিন্তায় আমার মাথাটাও কাজ করছে না।

--দোস্ত,আমি তো বললাম-ই সামনের তারিখটা আর মিস হবে না,প্লিজ।

--দেখ বন্ধু,তোর সেমিস্টার ফি-র শেষ তারিখ ছিলো বলেই আমি তোর বিপদের কথা চিন্তা করে ঐদিন টাকাগুলো দিয়েছিলাম।প্রায় মাস দেড়েক হয়ে গেলো।এরই মধ্যে তুই তিন-তিন দফা সময় নিয়ে নিলি।প্লিজ বন্ধু,তুই আর সময়ক্ষেপণ করিস না।তুই তো জানিসই টাকাগুলো আমাকে টিউশনি করে করে যোগাড় করতে হয়।অনেক কষ্ট করেই আমাকে সবকিছু মেইনটেইন করতে হয়।আজ যদি তুই আমার জায়গায় থাকতে তবে তোর কেমন লাগতো?একটু ভেবে দেখ তো,তোর মতো আচরণ যদি আমি তোর সাথে করতাম তবে কি তুই তখন সহ্য করতে পারতি?নিজেকে আমার আসনে বসিয়ে বিষয়টি একটু অনুধাবন করার চেষ্টা কর,প্লিজ।তখন বুঝতে পারবি,সময়মতো ধারের টাকা না পাওয়া কতোটা কষ্টের,কতোটা মানসিক চাপের বিষয়।

--বললামই তো দোস্ত আর মিস হবে না।

--এমন কথা তো তুই বারবার বলেই যাচ্ছিস।তুই নিজের ওয়াদাই তো ঠিক রাখছিস না রে ভাই। বিশ্বাস কর,তোর এমন আচরণ আমাকে খুব কষ্ট দিচ্ছে।এছাড়া,তোকে অনেক দিন ধরে দেখছি না! তুই এখন কোথায় আছিস?

--আমি তো বাড়িতেই আছি।

--কিন্তু তোর বাড়িতে খোঁজ নিতে গেলে তো আন্টি বারবার বলেন তুই নাকি ঘরের বাইরে।এভাবে কয়েকদিন তোকে খুঁজতে গিয়েছিলাম কিন্তু পাই নি।

--হ্যাঁ,দোস্ত!তখন হয়তো আমি বাইরেই ছিলাম।

--আবারও বলছি তারিখটা যেনো আর কোনোভাবেই মিস না হয়,বন্ধু।

--না,আর মিস হবে না,দোস্ত।

অতঃপর পরের দিন সকালে ইয়াছিন তার বাড়ির উঠোনের এপাশ থেকে ওপাশ হাঁটতে হাঁটতে চিন্তা করছিলো যে,জাভেদ তাকে এভাবে আর কতোদিন দৌঁড়াবে।সে কি আদৌ তার টাকাগুলো ফেরত দেবে নাকি এভাবে একের পর এক সময় নিতেই থাকবে।অপরদিকে,মুহিতকে তো আজকে টাকা দেওয়ারও কথা আছে।কিন্তু এখন পর্যন্ত তো টাকা মেনেজ হয় নি।আর যেহেতু তাকে কথা দেওয়া হয়েছে তাই তাকে এবার কোনো না কোনোভাবে তো ব্যবস্থা করে দিতেই হবে। অন্যথায়,আবারও ওয়াদা ভঙ্গ হয়ে যাবে যা তার স্বভাব বিরুদ্ধ একটি কাজ।আর এসব নিয়ে চিন্তা করার মধ্যখানে হঠাৎ মুহিত পিছন থেকে এসে বলল,

--ইয়াছিন,ভাই!আপনাদের বাড়ির রাস্তা দিয়েই যাচ্ছিলাম তাই ভাবলাম আপনাকে ফোন না দিয়েই দেখা করে যাই।আপনি আমাকে আজ টাকা দিবেন বলেছিলেন।

--হ্যাঁ,মুহিত!আমাকে দয়া করে একটু বিকেল পর্যন্ত সময় দাও।টাকাগুলো পেয়ে আমি তোমাকে ফোন দেবো।বাই দ্যা ওয়ে,তুমি কি ঐদিন কোথাও ধার পেয়েছিলে?

--জ্বি ভাই!অনেকের কাছে খোজাঁখুজির পর অবশেষে আমার এক খালা দিয়েছিলেন।আপনার কথামতো উনাকে আজকে ফেরত দিয়ে দেবো বলে কথা দিয়েছিলাম।

--তোমার নাম্বার তো আমার কাছে আছেই।আমিই তোমাকে বিকেলের দিকে ফোন দেবো।চিন্তা করো না।

--ঠিক আছে,ভাইয়া।আমি তাহলে এখন যাই।

ইয়াছিন আজকে ফজরের নামাজ আদায় করে চাচার সাথে মাসজিদ থেকে আসার সময় উনার কাছে দুই হাজার টাকা ধার চেয়েছিলো।তিনি দুপুরের দিকে তার কাছ থেকে টাকা নেওয়ার জন্য বলেছিলেন।অবশেষে সময়মতো চাচার কাছ থেকে টাকা পেয়ে মুহিবকে দেওয়া হয়েছে ঠিক কিন্তু তার মাথায় নতুন করে আরও অনেক টেনশন চেপে বসলো।একদিকে আগামী সপ্তাহে টিউশনি ফি দেওয়ার চিন্তা।অন্যদিকে,চাচার কাছ থেকে ধার নেওয়া টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার নতুন আরেক চিন্তা মাথায় চেপে বসলো।তার উপর জাভেদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের চিন্তা তো আছে-ই।কোথায় একজনকে ঋণ দিয়ে এখন ঐ ঋণ দেওয়ার প্রভাবে সে নিজেই আজ ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়লো।কী অদ্ভুত বিষয়, তাই না!

এতোদিন জাভেদের সাথে অন্তত যোগাযোগ করা সম্ভব হলেও এখন আর জাভেদকে ফোন দিলেও রিসিভ করে না।এমনকি বাড়িতে খোঁজ নিলেও তাকে পাওয়া যায় না।কেমন জানি পালিয়ে পালিয়ে বাঁচতে চায়।

একদিন আছরের নামাজ শেষে মসজিদের সামনের এক দেয়ালে একা একা বসে ইয়াছিন চিন্তিত মনে ভাবছিলো,কেনো যে মানুষজন এমন হয়।একজন মানুষকে যেখানে আমি তার বিপদে ধার দিয়ে সাহায্য করলাম সেখানে কৃতজ্ঞতা জানানো তো দূরে থাক, নিজে এসে ঋণ পরিশোধ করা তো দূরে থাক বরং আমি নিজেকেই আজ বিপদে ফেলে দিলো বন্ধু নামের এক মানব।

পরিচিতি মানুষের এমন অদ্ভুত আচরণ নিয়ে ভাবতে থাকা ইয়াছিনের সামনে হঠাৎ হাজির হলেন মসজিদের ইমাম সাহেব।এসেই তাকে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

ইয়াছিন ভাই,কী ব্যাপার?আপনাকে যে আজ খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে?

--ওয়ালাইকুম'আসসালাম!এই তো হুজুর দুঃখের কথা আর কী বলি!আমার পরিচিত একজনকে কিছু টাকা ধার দিয়েছিলাম।কয়েক দফা তারিখ করেও বেচারা তো টাকা দেই-ই নি বরং এখন সমস্ত যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে।তার কাছ থেকে টাকাগুলো পাবো মনে করে আরেকজন অসহায় মানুষকে ধার দেবো বলে কথাও দিয়েছিলাম।শেষ পর্যন্ত ওয়াদা রক্ষার্থে আমার চাচার কাছ থেকে ধার এনে ঐ ব্যক্তিকে টাকা দিয়েছি ঠিক কিন্তু এখন আমি নিজেই ঋনগ্রস্ত হয়ে পড়েছি।এছাড়া,সামনে আমার ভার্সিটির টিউশন ফি দেওয়ার কথা।কীভাবে যে এগুলো মেনেজ করি তা বুঝে ওঠতে পারছি না।এগুলোর চিন্তায় রাতে ঠিকমতো ঘুমও হয় না।আর এখন এগুলো নিয়েই চিন্তার নিঃশ্বাস ফেলছি,হুজুর।

--সত্যিই বিষয়টি অনেক দুঃখজনক।আজ নয় কাল এভাবে বারবার কথা দিয়ে কথার খিয়ানত করা কোনোভাবেই একজন মুসলিমের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না।রাসূল (সাঃ) মুনাফিকের তিনটি বৈশিষ্ট্যের একটিতে বলেছেন যে,তারা কথা দিয়ে কথা রাখে না অর্থাৎ ওয়াদা ভঙ্গ করে।অন্য এক হাদীসে রাসূল (সাঃ) বলেছেন যে,যার আমানতদারী নেই তার ঈমান নেই এবং যার ওয়াদা ঠিক নেই তার দ্বীন নেই। [১]

সুতরাং কথার বরখেলাপ করা কোনোভাবেই মুসলিমসুলভ আচরণের অন্তর্ভুক্ত নয়।আবার এভাবে কাউকে কথা দিয়ে সময়মতো টাকা ফেরত না দিলে ঐ ঋণদাতা ব্যক্তি পরবর্তীতে আর কাউকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলবে এবং একইসাথে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়বে।ফলে অনেক সৎ মানুষও তখন ঋণ পাওয়া থেকে বঞ্চিত থেকে যাবে।আর এদের কারণেই মানুষেরা আজকে কাউকে ঋণ দিতে সাহস পায় না,মনের মধ্যে এক ধরণের ভয় কাজ করে।আর এতে অনেক ভালো মানুষেরাও তাদের চরম বিপদের সময় ঋণ পাওয়া থেকে বঞ্চিত থেকে যায়।অর্থাৎ একজনের খারাপ প্রভাব আরও অনেক ভালো মানুষের উপরও পড়ে।

অবশ্য এটা ঠিক যে,কেউ যদি আন্তরিকভাবে চেষ্টা করার পরও কোনো যৌক্তিক কারণে যথাসময়ে টাকা দিতে না পারে তবে সেটা দোষের কিছু নয়।কিন্তু দোষ তখনই হয় যখন টাকা পরিশোধের ব্যাপারে কোনো ধরণের আন্তরিকতা না থাকে কিংবা গড়িমসি থাকে।

আবার,কেউ যদি আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেও কোনো কারণে সময়মতো টাকা দিতে অক্ষম হয় তবে তার উচিত টাকা দেওয়ার নির্দিষ্ট তারিখ আসার পূর্বেই বিনয়ের সাথে ঋণদাতাকে জানানো যে,ভাই!আমার অমুক তারিখে আপনার টাকা দেওয়ার কথা ছিলো কিন্তু এই এই কারণে আমি আপনার টাকা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দিতে পারছি না।আমাকে দয়া করে আরও কিছু সময় দিন।এভাবে বিনয়ের সাথে বুঝিয়ে বললে ঋণদাতার বিশেষ কোনো সমস্যা না থাকলে নিশ্চয়ই তিনি বিষয়টি বিবেচনা করবেন।এছাড়া,নির্দিষ্ট সময়ের ভিতর টাকা দিতে না পারলে ঋণদাতাকে আগে থেকে জানালে উনারও একটি মানসিক প্রস্ততি থাকে যে,আমি নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে আমার পাওনা টাকাগুলো পাচ্ছি না।ফলে তিনিও আর এই টাকার কথা চিন্তা করে অন্য কোনো কাজে আগাবেন না কিংবা আপনার মতো অন্যকে ধার দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিবেন না।

আর এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে যে,ঋণগ্রহীতা নতুন করে সময় নেওয়ার পূর্বে এমন সময় নেওয়া উচিত যে সময়ের ভেতর আসলেই তার পক্ষে ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব অর্থাৎ বুঝেশুনে নতুন তারিখ নিতে হবে।একইসাথে,সেই তারিখের মধ্যে পরিশোধ করার জন্য তৎপর থাকতে হবে। অন্যথায়,বিশ্বাস তো হারাবেই এমনকি তার প্রতি ঋনদাতার নিকট এক ধরণের বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি হবে।ফলে এমন বিষয়কেও ছোটো করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। 

অন্যদিকে,ঋণগ্রহীতা যদি অভাবগ্রস্থ হওয়ার কারণে ঋণ পরিশোধ করতে না পারে তবে তার উচিত ঋণদাতার কাছে এসে বিষয়টি সম্পর্কে খোলাসা করে বলা।তখন হয়তো ঋণদাতা বিষয়টির প্রতি শিথিলতা অবলম্বন করতে পারেন। আর এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তা'য়ালা বলেছেন,"ঋণী যদি অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়ে তাহলে (তার ওপর চাপ দিয়ো না বরং) তার সচ্ছলতা ফিরে আসার আগ পর্যন্ত তাকে অবকাশ দাও,আর যদি তা মাফ করে দাও তাহলে তা হবে তোমাদের জন্য অতি উত্তম কাজ-যদি তোমরা তা (ভালোভাবে) জানো।" [২]

--হুজুর,আপনি প্রতিটি কথাই খুব সুন্দর করে বলেছেন।আসলে আমি জানি না আমার বন্ধু ঠিক কী কারণে আমার টাকা পরিশোধ করছে না। অভাবের কারণে হয়ে থাকলে তো তার আমাকে জানানো উচিত ছিল।যাইহোক,তবুও আমি ধৈর্য্য ধারণ করবো এবং তার প্রতি সুধারণাই রাখবো। হয়তো অভাবের কারণেই টাকাগুলো পরিশোধ করতে পারছে না।কোরআনের এই আয়াত আমার জন্য একটি অনুপ্রেরণামূলক আয়াত।এই আয়াত জানার পর থেকে আমি ইতোমধ্যে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছি,আমার যতো কষ্টই হোউক না কেনো আমি টাকার জন্য তার নিকট বা তার পরিবারের কাছে আর কিছু বলবো না।সে পরিশোধ না করলে আমি সবর করে ফেলবো।এমনকি মাফ করে দেবো।আর আপনার বলা ওই আয়াতের আলোকে আল্লাহর দৃষ্টিতে এমন কাজই তো উত্তম কাজ।তাই না!আর আমি এমন উত্তম কাজের হাতছাড়া করতে চাই না।

--ইয়াছিন সাহেব,লোকমুখে আপনার অনেক প্রশংসা শুনেছি।আজ বুঝতে পারলাম কেনো তারা আপনার প্রশংসা করে।সত্যিই আপনি অনেক উদারমনা এবং ধৈর্য্যশীল একজন মানুষ। আজকাল এসব বিষয়ে নমনীয় হতে পারা মানুষের সংখ্যা খুবই নগন্য।আপনার কাছ থেকে এ গ্রামের যুবকদের অনেক কিছুই শেখার আছে। 

--অবশ্য এটা সত্য যে,পাওনা টাকাগুলো না পাওয়া আমার জন্য ভীষণ কষ্টকর একটি বিষয়।কেননা সামনে আমার টিউশন ফি-সহ চাচার কাছ থেকে আনা ঋণ পরিশোধ করতে হবে।কিন্তু সবকিছুর পর আপনার কাছ থেকে ওই আয়াত শুনার পর থেকে আমি সবর ও ক্ষমার নীতি অবলম্বন করতে চাই যাতে আখিরাতে আমি আরও বড়ো পরিসরে পুরষ্কৃত হতে পারি।আমার জন্য দোয়া করবেন হুজুর যাতে মহান আল্লাহ তা'য়ালা আমার জন্য সবকিছু সহজ করে দেন।

--অবশ্যই ইয়াছিন ভাই,আপনার জন্য দোয়া করি।
আপনাকে একটি দোয়া শিখিয়ে যাই।এই দোয়াটি সবসময় পড়লে আল্লাহ আপনার কাজকর্ম সহজ করে দিবেন।ইন শা আল্লাহ!সেই দোয়াটি হচ্ছে এমন 

رَبَّنَاۤ اٰتِنَا مِنۡ لَّدُنۡکَ رَحۡمَۃً وَّ هَیِّیٴۡ لَنَا مِنۡ اَمۡرِنَا رَشَدًا

এর অর্থ হচ্ছে,হে আমাদের রব!আপনি নিজ থেকে আমাদেরকে রহমত দান করুন এবং আমাদের জন্য আমাদের কাজকর্ম সঠিকভাবে পরিচালনার ব্যবস্থা করুন। [৩]

--মা শা আল্লাহ!আমি এখন থেকে সবসময় এই দোয়াটি পড়বো।আর আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, হুজুর।আপনার কাছ থেকে অনেক মূল্যবান কিছু শিখতে পারলাম।আলহামদুলিল্লাহ! 

--জাযাকাল্লাহু খাইর।ঠিক আছে,এখন আমি যাই, ইয়াছিন ভাই।মাগরিবের সময়ের আর বেশি বাকি নেই।আপনার সাথে পরে কথা হবে।ইন শা আল্লাহ!

পরদিন দুপুরে পথিমধ্যে চাচার সাথে দেখা হলে চাচা তাকে বললেন,ইয়াছিন!তোমাকেই মনে মনে আমি খুঁজতেছিলাম।যাইহোক,তোমাকে পেয়ে যাওয়াতে ভালোই হলো।

ইয়াছিন খানিকটা অবাক হয়ে হাতে থাকা মোবাইলের ক্যালেন্ডার চেক করতে করতে জিজ্ঞেস করলো,কেনো চাচা?এখনো তো আরও কিছুদিন বাকি আছে? 

তিনি স্মিত হেসে বললেন,আরে না!ধার নিয়ে তুমি চিন্তা করো না।আমি তোমাকে খুঁজছি এটা বলার জন্য যে,আমার বড়ো ছেলে অর্থাৎ তোমার ভাই বিদেশ থেকে কিছু টাকা পাঠিয়েছিলো এবং তোমাকে তিন হাজার টাকা দিতে বলেছে।সে বলেছে তোমার কোনো কাজে খরচ করে নিয়ো। এই নাও তোমার টাকা।

ইয়াছিন টাকা হাতে নিতে নিতে আনন্দের স্বরে চাচাকে বলল,উনি কষ্ট করে এসব আমাকে দিতে গেলেন কেনো!চাচা,তাহলে আপনার পাওনা ওই দুই হাজার টাকা এখান থেকেই রেখে দিন।আর আমার ইকবাল ভাই,কেমন আছেন?

--ঠিক আছে,তাহলে এই নাও তোমার বাকি টাকা। আর হ্যাঁ,আল্লাহর রহমতে ইকবাল ভালোই আছে।

চাচা চলে যাওয়ার পর ইয়াছিন মনে মনে ভাবলো, সবুরের ফল আসলেই বড়ো মিষ্টি এবং আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল 'আলহামদুলিল্লাহ!' কে ভেবেছিলো এই দুঃসময়ে চাচাতো ভাই ইকবাল এই টাকাগুলো দিবে।আল্লাহ তা'য়ালাই কোনো না কোনোভাবে তার ধৈর্য্যশীল বান্দাকে সাহায্য করেন।সেজন্যই আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল রাখা প্রত্যেক মু'মিনের কাজ।আর আল্লাহর ওপর ভরসা রাখলে কোথা থেকে অর্থ আসবে কিংবা কোথা থেকে রিজিক আসবে তা কেউ কল্পনাই করতে পারবে না।কারণ আল্লাহ তা'য়ালা বলেছেন,‘যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করবে,তিনি তার জন্য সংকট থেকে বের হয়ে আসার একটি পথ তৈরী করে দেন এবং তিনি তাকে এমন জায়গা থেকে রিজিক দান করেন যার উৎস সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই নেই;যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করে তার জন্য তিনিই যথেষ্ট,আল্লাহ তার ইচ্ছা পূরণ করবেনই।’ [৪]

আর এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে কিছুদূর যাওয়ার পর দেখা হলো সেই মুহিবের সঙ্গে।দেখা হতে না হতেই প্রথমে ইয়াছিন সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

মুহিব,আমার চাচার বর্তমান কী অবস্থা?চাচার খবর নিতে তোমাদের ওদিকেই যাচ্ছিলাম।

--আলহামদুলিল্লাহ,ভাই!আমার বাবা এখন অনেকটাই সুস্থ।ভাই,আপনার সেদিনকার করা সাহায্য আমার সারাটা জীবন মনে থাকবে।সবচেয়ে বড়ো কথা আপনি যেভাবে আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন তা সত্যিই আমাকে অনেক সাহস যুগিয়েছিল।প্রথমে আমি বাবার অসুস্থতা দেখে ভেঙে পড়েছিলাম।কী করবো না করবো তা-ও ভেবে পাচ্ছিলাম না।কিন্তু আপনার সান্ত্বনামূলক কথা এবং আশ্বাসের বাণী আমাকে সাহসী করে তুলেছিল, পেয়েছিলাম শক্ত মনোবলও।আসলে, বিপদের সময় কারো কাছ থেকে কমপক্ষে সান্ত্বনা বাণী পাওয়া যে মনে কতোটা শান্তি বয়ে আনে তা আমি বলে বুঝাতে পারবো না।সেদিন আপনার কথাগুলোয় আমি অন্যরকম এক শান্তি পেয়েছিলাম।

--না,তেমন কিছুই আমি করতে পারি নি।আমি বরং তোমাকে একবার টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েও সময়মতো দিতে পারি নি।এর জন্য আমার মধ্যে এখনও অনুতাপ কাজ করে।

--কী যে বলেন ভাই!আপনি যা করেছেন তা-ই আমার জন্য অনেক কিছু ছিলো।আমি আপনার কাছে কতোটা কৃতজ্ঞ,কতোটা ঋণী তা বলে বুঝাতে পারবো না।দোয়া করি আল্লাহ আপনাকে সবসময় ভালো রাখুন।আচ্ছা ভাই,আপনি কি কিছু শুনেছেন?

খানিকটা বিস্মিত চেহারায় ইয়াছিন জিজ্ঞেস করলো,কেনো?কিছু হয়েছে নাকি?

--কী বলেন ভাই।আমি তো ভেবেছি আপনি হয়তো তা জানেন।

--আরে মুহিত,কী হয়েছে সেটা তো আগে বলবে?

--এই তো আজ সকালে আপনার বন্ধু জাভেদ ভাই ছিনতাইকারীর স্বীকার হয়েছেন।শুনেছি, ছুরিকাঘাত হয়ে বর্তমানে হসপিটালে ভর্তি আছেন।অবস্থা তেমন ভালো না।প্রচন্ড জখম হয়েছে।  

--ইন্না-লিল্লাহ...!এ কী বলো,মুহিত? 

--জ্বি,ভাই!আমি এই কিছুক্ষণ আগেই শুনে এসেছি। 

--তাহলে আমি এখন যাই।তার বাড়িতে গিয়ে একটু খবর নিয়ে আসি।

ইয়াছিন তার বাড়িতে গিয়ে খবর নিলে জাভেদের চাচি হাসপাতালের নাম বলে দিলেন।উনার কাছ থেকে কেবিন নাম্বারসহ হাসপাতালের ঠিকানা নিয়ে ইয়াছিন সেখানে তার বন্ধুকে দেখতে ছুটে গেলো।

তারপর সেখানে যাওয়ার পর কেবিনের দরজার সামনে মলিন চেহারায় দাঁড়িয়ে থাকা জাভেদের বাবার সাথে দেখা হয়ে গেলো।তাই সে ভেতরে প্রবেশ করার পূর্বে তার বন্ধুর সার্বিক অবস্থা এবং ঘটনা কী হয়েছিল তা জানতে চাইলে তার বাবা আদ্র কন্ঠে বললেন,

আজ সকালে ব্যাংক থেকে কুঁড়ি হাজার টাকা তুলে নিয়ে আসার পথে সে কিছু ছিনতাইকারীর কবলে পড়েছিল।জোরজবরদস্তি ছাড়াই টাকাগুলো দিয়ে দেওয়ার পরও বড়ো অদ্ভুতভাবে ওরা আমার ছেলেকে এলোপাতাড়ি আঘাত করলো।আচ্ছা,বলো তো,বাবা!টাকা দিয়ে দেওয়ার পরও আঘাত করার কি কোনো মানে ছিলো?ছিনতাইকারী বলে কথা!

তারপর তিনি ছেলের ব্যাপারে বললেন,জাভেদের বর্তমান অবস্থা তেমন একটা ভালো না।শরীরের বেশ কয়েক জায়গায় গুরুতর জখম হয়েছে এবং প্রচুর রক্তপাতও হয়েছে।বর্তমানে সেলাইন চলছে। ডাক্তার বলেছেন জরুরী ভিত্তিতে এক ব্যাগ রক্ত লাগবে।তার রক্তের গ্রুপের রক্তও মিলাতে পারছি না।অনেক জায়গায় ডোনেটরের খুঁজাখুঁজি চলছে।এখন পর্যন্ত পাওয়া যায় নি।

 --চাচা,জাভেদের রক্তের গ্রুপ কী?

--বাবা ইয়াছিন,তার রক্তের গ্রুপ হচ্ছে এ পজিটিভ।

--আলহামদুলিল্লাহ!তাহলে আর দেরি কিসের!ওর রক্তের গ্রুপের সাথে আমার রক্তের গ্রুপের মিল রয়েছে।আপনি কোনো চিন্তা করবেন না,চাচা। আপনি কেবল ডাক্তারকে রক্ত নেওয়ার ব্যবস্থা করতে বলুন।আমি সম্পূর্ণ প্রস্তুত আছি।

--ঠিক আছে,বাবা!তোমার কথা শুনে খুব ভালো লাগলো।আমি ডাক্তারকে এক্ষুণি গিয়ে বলছি। 

অবশেষে ইয়াছিন তার বন্ধু জাভেদের জন্য টাটকা এক ব্যাগ রক্ত দিয়ে তার সাথে দেখা করতে গেলে জাভেদ তাকে তার সামনে দেখা মাত্রই ইতস্ততাবোধ করা শুরু করলো।হয়তো তখন তার সেই ধোঁকাবাজির কথা মনে পড়ে গিয়েছিল।কিন্তু ইয়াছিন একবারও তার পাওনা টাকার কথা কিছু না বলে বরং তার কাছ থেকে ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ার পুরো ঘটনাটি আবারও শুনে নিলো।

তারপর জাভেদ যখন তার বাবার কাছ থেকে জানতে পারলো যে,তারই বন্ধু ইয়াছিন তাকে রক্ত দিয়েছে তখন সে এই ভেবে অপরাধবোধ করতে লাগলো যে,এই সেই বন্ধু যে একবার তার বিপদের সময় তিন হাজার টাকা ধার দিয়ে সাহায্য করেছিল।অথচ সেগুলো তো ফিরিয়ে দেওয়া হয়-ই নি বরং নানা বাহানা করতে করতে একসময় যোগাযোগ পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন রেখেছিল। আবার আজও সেই একই বন্ধু নতুন করে আরেক বড়ো বিপদের সময় সাহায্য করে গেলো।তার প্রতি তার বন্ধুর এমন ভালোবাসার বিষয়টি তার হৃদয়ের গহীনে স্পর্শ করলো।

জাভেদ মনে মনে ভাবতে লাগলো,আসলে এগুলো সবই তার পাপেরই ফল।সে বুঝতে পারলো এভাবে কারো হক নষ্ট করে হয়তো সাময়িক কিছু ফায়দা হাসিল করা যায় কিন্তু এর পরিণাম সত্যিই বড়ো ভয়াবহ আকারের হয়। সামান্য কিছু ধোঁকাবাজি অসামান্য ক্ষতি বয়ে আনে যা তাকে হসপিটালের বেডে থেকে চরমভাবে উপলব্ধি করতে হচ্ছে।

সে গভীরভাবে আরও চিন্তা করতে লাগলো যে, ছিনতাইকারীদের কথার সাথে সাথেই টাকাগুলো দিয়ে দেওয়ার পরও ওরা আঘাত করলো কেনো। এ বিষয়টি তাকে প্রচন্ডভাবে ভাবিয়ে তুলেছে।সে বুঝতে পারছে এগুলো তার পুরোনো পাপের এক কঠিন শাস্তি বটে।তার মনে পড়ে গেলো,কিছুদিন আগে এক জুম্মাবারে ইমাম সাহেবের বলা সেই কথাগুলো যেখানে তিনি বলেছিলেন যে,আল্লাহ তা'য়ালা বলেছেন,(হে মানুষ) যে বিপদ আপদই তোমাদের ওপর আসুক না কেনো,তা হচ্ছে তোমাদের নিজেদের হাতের কামাই,(তা সত্ত্বেও) আল্লাহ তা'য়ালা তোমাদের অনেক (অপরাধ এমনিই) ক্ষমা করে দেন। [৫]

সে এখন উপলব্ধি করতে পারছে যে,এমন বিপদ মূলত তার হাতের কামাই ছিলো।কুঁড়ি হাজার তো গেলোই, সাথে বেশ গুরুতরভাবে আহত হতে হলো।অথচ তার বন্ধুর ধারের মাত্র তিন হাজার টাকা দিতে কতোই-না তাল-বাহানা করেছিলো। আর আজ তার আর্থিক এবং শারীরিকভাবে কতো বড় ক্ষতি হয়ে গেলো।এ যেনো কারো করা এক ক্ষতি নিজের অসামান্য ক্ষতি বয়ে আনলো।

পরবর্তীতে সুস্থ হয়ে যাওয়ার পর সে নিজে ইয়াছিনের বাড়িতে গিয়ে তার পাওনা টাকাগুলো ইয়াছিনের না চাইতেই ফিরিয়ে দিলো।একইসাথে,বিপদের সময় পাশে দাঁড়ানোর জন্য বন্ধুর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের পাশাপাশি পূর্বের ভুলের জন্য ভীষণ লজ্জিত হয়ে আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করলো।পক্ষান্তরে,অনেকটা সহজ সরলমনা ইয়াছিনও খুশিমনে তাকে মাফ করে দিয়ে বুকে জড়িয়ে নিলো।

 
রেফারেন্সঃ

[১] সহীহ ইবনে হিব্বান : ১/৪২২,হাদীস : ১৯৪
[২] সূরা আল-বাকারা,আয়াত নং : ২৮০
[৩] সূরা আল-কাহাফ,আয়াত নং : ১০
[৪] সূরা আত তালাক,আয়াত নং : ২-৩
[৫] সূরা আশ শূরা,আয়াত নং : ৪২

কিছু কথাঃ

দেখুন,আমরা অনেক সময় মানুষের কাছ থেকে ধার নিয়ে সময়মতো তা ফিরিয়ে দেই না বরং আজ নয় কাল,কাল নয় পরশু এসব বলে বিভিন্ন ধরণের তালবাহানা শুরু করে দেই।আর এক সময় যোগাযোগ পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন করে আত্নগোপনে থাকার চেষ্টা করি।আর এভাবে কৃতজ্ঞহীন আচরণ করা শুরু করি যা খুবই দুঃখজনক।এগুলো নিঃসন্দেহে একজন মানুষের নেতিবাচক ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে তুলে।আসলে,কেউ কারো হক নষ্ট করে সাময়িক কিছু সুবিধা ছাড়া আর কিছুই করতে পারে না।একসময় অন্যের হক নষ্ট করার মাশুল দুনিয়াতেই বড়ো কঠিনভাবে দিতে হয় যা আমরা বাস্তবতার আলোকে সাজানো উপর্যুক্ত গল্প থেকে জানতে পারলাম।গল্পের জাভেদ কোনো এক ধাক্কায় শেষ পর্যন্ত তার মূল অপরাধ বুঝতে পেরেছিল বটে।এমনকি ক্ষমা চাওয়ার পাশাপাশি তার বন্ধুর হক পাই পাই করে আদায়ও করে দিয়েছিল।কিন্তু আমরা কি মানুষের কোনো হক নষ্ট করার অপরাধটুকুও উপলব্ধি করতে পারছি নাকি নিশ্চিন্তমনে দিনের পর দিন কাটিয়ে যাচ্ছি? তবে জাভেদের মতো কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে না তো?

সবশেষে,একটি কথা বলে রাখি,হাক্কুলাহ তথা আল্লাহর হক নষ্ট করলে আল্লাহর কাছে মাফ চেয়ে তার ক্ষমা পাওয়া যায় বা আল্লাহ ক্ষমা করবেন।কিন্তু হাক্কুল ইবাদ তথা বান্দার হক আল্লাহ ততোক্ষণ ক্ষমা করবেন না যতোক্ষণ ঐ ব্যক্তি নিজে ক্ষমা না করবে।কিন্তু কথা হচ্ছে,ঐ ব্যক্তি মারা গেলে ক্ষমা আদায় করবেন কীভাবে।কাজেই জীবিত থাকতে মানুষের হক পরিপূর্ণভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে।অন্যথায়,নিজের করা সীমিত নেক আমল দিয়ে আখিরাতে ওই ব্যক্তি তথা হকদার মানুষদের হক পুষিয়ে দিতে দিতে একসময় হয়তো আর কোনো আমলই অবশিষ্ট থাকবে না।তখন আপসোস ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না।তাই সাবধান,খুবই সাবধান!

#Copy:Facebook

1 Comments

Post a Comment

Previous Post Next Post